
কন্ঠশিল্পী ঝিনুক
পুরো নাম হামিদা আকতার। সংক্ষিপ্ত নাম ঝিনুক। একসময় গানে গানে শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখতেন। এখন অনেকটাই স্তিমিত। তিন্তু তার মধুর কন্ঠটি রয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে বেতারে মৌলিক গান করে থাকেন।
সংসারের বোঝা টেনে আর দুই মেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে তিনি গানে তেমন সময় দিতে পারছিলেন না। শান্ত স্বভাবের ঝিনুকের বড় মেয়ে ঐশী পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্লাসিক্যাল নৃত্যশিল্পী। একসময় স্টেজ মাতিয়ে রাখত। সে পর্তুগাল নিবাসী। সেখানে সে গ্র্যাজুয়েশন সমাপ্ত করেছে। বর্তমানে সে স্বামীর সাথে লিসবনে বাস করছে। লিসবনেও সে বিজয় দিবস ও অন্যান্য দিবসে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য প্রদর্শন করে দর্শক মাতিয়েছে।
ছোটো মেয়ে অতশী এ-লেভেলে পড়ছে। নাচ-গানে তারও আগ্রহ, এবং সে পড়াশোনার সাথে সাথে নাচ-গানও চালিয়ে যাচ্ছে।
জোয়ানা ঐশী
জিনিয়া অতশী
পুরো পরিবারটিই সংস্কৃতিমনা। ঝিনুকের স্বামীও একজন সংগীতশিল্পী। তবে তাদের একসাথে পথচলাটা মসৃণ ছিলো না ঝিনুকের। দুই মেয়েকে গড়ে তোলার গুরুভার নিজ কাঁধে তুলে নেন কন্ঠশিল্পী ঝিনুক। তিনি অনেক গুণে গুণান্বিতা। হেয়ারস্টাইলার, ফ্যাশন, মেকআপ-এ পারদর্শী এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তার রয়েছে। অনেক পুরস্কারও লাভ করেছেন তিনি।
তার সাথে কথোপকথন হয় সোমবার (২৮ এপ্রিল):
প্রশ্ন: গানের জগতে প্রবেশ কীভাবে?
উত্তর: আমার স্বামীর অনুপ্রেরণাতেই।
প্রশ্ন: তার নাম?
উত্তর: জাহেদউদ্দিন হেলাল। সে একজন ভালো কন্ঠশিল্পী। যদিও এখন আমাদের দুজনের পথ চলাটা আলাদা হয়ে গেছে। দুই মেয়ের দায়িত্ব আমিই নিয়েছি, মানুষ করছি।
প্রশ্ন: সংগীতে আপনার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা…
উত্তর: হ্যাঁ, তবে এটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে হয়েছে। প্রথমে শিক্ষা নিই ওস্তাদ মানিক ভট্টাচার্যের কাছে। এরপর আমি ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসে আরো দুজনের কাছে তালিম নিই। আবদুল করিম ও বিপুল ভট্টাচার্যর কাছে। ২০০১ সালে আমি বাংলাদেশ বেতারে এনলিস্টেড হই।
প্রশ্ন: চমৎকার। তখনও আপনাদের একসাথে পথচলাটা ছিলো?
উত্তর: ছিলো। আলাদা হয়ে যাবার বিষয়টি খুব একটা বেশি সময় আগের না।
দৃশ্যপট: ঢাকা। নৃত্যের জন্য প্রস্তুত ঐশী
প্রশ্ন: আচ্ছা। তারপর সংসার চলতো কী করে?
উত্তর: আমি বহু আগে থেকেই হেয়ারস্টাইলিং ও মেকআপে ট্রেনিং নিয়ে আসছিলাম। একসময় এই কাজগুলোতে পারদর্শী হয়ে উঠি এবং যথেষ্ট নাম-ডাক হয় আমার। একটা বিউটি পারলারেও ছিলো আমার। আর তখনও আমি নিয়মিত বেতারে-স্টেজে গান করে যাচ্ছিলাম।
প্রশ্ন: এসব করতে গিয়ে তো অনেক পরিশ্রম হতো আপনার। বাধা পেয়েছিলেন কোনোভাবে?
উত্তর: তেমন বড় কিছু না। বাধা বলতে, সময়টা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য বাধা তো থাকবেই। তবে আমি কখনও মনোবল হারাইনি। আর সাফল্য পেতে আমার ভেতরের জেদ আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
কন্ঠশিল্পী ঝিনুক
প্রশ্ন: কী ধরনের গান আপনি করেন আর প্রিয় শিল্পী ?
উত্তর: আধুনিক গানই বেশি করি। তবে রবীন্দ্রসংগীত আমার ভালো লাগে। প্রিয় গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন, সৈয়দ আবদুল হাদী, বশির আহমেদ, ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী ও নিলুফার ইয়াসমিন। আর আপনার কন্ঠের গান আমাকে মুগ্ধ করে।
প্রশ্ন: যে ক’জন কন্ঠশিল্পীর নাম করলেন, তারা আমারও প্রিয়। আর কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী বশির আহমেদ তো আমার ওস্তাদজী ছিলেন। সাবিনা ইয়াসমিন আপার সুস্থতার জন্য দোয়া করি। তাদের কোনো গান কাভার করেছেন?
উত্তর: বেশ কয়েকটি।
প্রশ্ন: পল্লীগীতি বা ভাটিয়ালী গানের প্রতি আপনার দুর্বলতা আছে? কোনো প্রিয় শিল্পী আছেন?
উত্তর: কিছুটা তো আছেই। আমার বেইজটা হলো আধুনিক গান। পাশাপাশি অন্য গানও তো করতে হয়। প্রিয় শিল্পী হলেন আবদুল আলিম ও আশরাফ উদাস। আশরাফ উদাসের সান্নিধ্যে এসেছিলাম, গানও করেছিলাম। আর কিংবদন্তি আবদুল আলিমের গান তো শৈশব থেকে রেডিয়ো-টিভিতে শুনে এসেছি।
বইমেলা-২০২৪, অতশী
ঐশী ও তার বর মোতাসিম
ঝিনুকের কন্ঠে একটি গান শুনুন এখানে:
https://drive.google.com/file/d/1fdu3bRUGKt1Pcf6x8hMKIQyG5YKXXOEQ/view?usp=drive_link
প্রশ্ন: গান নিয়ে স্মৃতিচারণ করুন।
উত্তর: আগে তো বাসায় নিয়মিত গানের আসর বসতো। জাহেদউদ্দিন হেলাল গান করতো, প্রতিষ্ঠিত অনেক কন্ঠশিল্পীরা আসতেন। আমি শুনতাম, গাইতাম। আর আমার মেয়ে দু’টো শ্রোতা হয়ে গান শুনতো। ওরা তখন অনেক ছোটো যদিও।
প্রশ্ন: গান নিয়ে কোনো রোমাঞ্চকর বা মজার ঘটনা ঘটেছিলো, বা বেদনার?
উত্তর: বেদনার তো নয়ই; মজার ঘটনাই ঘটেছিলো। একবার বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদ আয়োজিত গাজীপুরে পিকনিকে গিয়ে গান গাইতে উঠলাম। হঠাৎ এমন নার্ভাসনেস চলে এলো যে, আমি গা্নই করতে পারছিলাম না। তখন আমার এক বান্ধবী এসে আমাকে অনেকটা ঠেসেই জড়িয়ে ধরলো। শেষ পর্যন্ত গান টা করতে পেরেছিলাম। (হাসি)
কন্ঠশিল্পী ঝিনুক, কথাশিল্পী ও সংগীতশিল্পী হাসান জাহিদ ও অতশী
প্রশ্ন: আসলে এমনটা হয়। শিল্পকর্মের মধ্যে সংগীত, আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি–এসব খুব কঠিন কর্ম। একবার কোনো এক অনুষ্ঠানে গান করতে গিয়ে আমি এক গ্লাস পানি চেয়েছিলাম। আর কোনো ঘটনা মনে পড়ে কি?
উত্তর: হুম। সেটার সাথে আপনিও জড়িত ছিলেন। আপনার বাসায় মরহুম ওস্তাদ পারভেজ ভাই নিয়মিত আসতেন। তিনি আপনার প্রতিবেশী বড়ভাই ছিলেন, আপনার কাছেই জেনেছি। আপনার গানের সাথে তবলা বাজাতেন তিনি। উনার মাধ্যমেই আপনার সাথে আমার পরিচয় ঘটে। উনি ছিলেন হেলালের বন্ধু। তো, একদিনের কথা। বেতারে গান করতে হবে। পরদিনই। গান না করলে আমার এনলিস্টমেন্ট বাতিল হয়ে যাবে। সুর, গানের কথা, বাদ্যযন্ত্র, যন্ত্রী কিছুই নেই। আমি আপনাকে ফোন করে জানলাম আপনার বাসায় পারভেজ ভাই আছেন। দৌড়ে চলে এলাম। পারভেজ ভাই আপনাকে বললেন, এই মুহূর্তে একটা গান লিখে দাও। আপনি খুব কম সময়ে গান লিখে দিলেন। পারভেজ ভাই আপনার হারমোনিয়াম নিয়ে অল্পসময়ে সুর তুলে ফেললেন। তারপর তার সাথে আমাকে গাওয়ালেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে হারমোনিয়াম দিয়ে নিজে তবলা বাজাতে লাগলেন। গান টা সম্ভবত তিনি দাদরা তালে ফেলেছিলেন। গান টা আমার অনেকটাই আয়ত্তে এসে গেলে আপনি আপনার রেকর্ডিং মেশিনে রেকর্ড করে ফেললেন। তারপর সেটা কম্পিউটারে নিয়ে আমাকে ম্যাসেঞ্জারে দিয়ে দিলেন । পারভেজ ভাই বললেন, রাতে গিয়ে ভালো করে প্র্যাক্টিস করবেন। পরদিন বেতারে এটা নিয়ে উনাদেরকে দেবেন।
আমি সেভাবেই কাজ করলাম। রেডিয়ো অফিসে গিয়ে দুই তিনবার প্র্যাক্টিস করার পর ফাইনাল করা হয়। সেই যাত্রায় পার পেয়ে গেলাম।
প্রশ্ন: হুম। মনে হয় যেন সেদিনের ঘটনা। আমার প্রায়ই মনে পড়ে সেই সন্ধ্যাটার কথা। সম্ভবত এই ঘটনার অল্পদিন পরেই পারভেজ ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সেইসময় ঐশী আমার কাছে আইলটস পড়তে আসতো। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি ঐশীকে গান শেখাতে লাগলাম। প্রথমে আপনি জানতে পারেননি। পরে জেনেছিলেন এবং আনন্দিত হয়েছিলেন। কারণ পারভেজ ভাইয়ের সংগীত পরিচালনায় আমি ও ঐশী দ্বৈত গান গেয়েছিলাম। সেসব আজ স্মৃতি।
উত্তর: হ্যাঁ, সময় খুব দ্রুত চলে যায়। আমি আপনাকে চিনতাম না। আপনি আমাকে চিনতেন না। পারভেজ ভাই হেলালের বন্ধু ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি আমাদের বাসায় আসতেন। আমার মেয়ে ঐশীকে আইলটস পড়ানোর জন্য উনিই আমাকে ফোন করে জানান। তারপর তো…
প্রশ্ন: বিচিত্র যোগসূত্র। গোপিবাগে পরভেজ রব ভাই আমার একটু সিনিয়র ভাই ছিলেন। পরে তো তিনি মালয়েশিয়ায় চলে যান সপরিবারে। ফিরেও আসেন। এসে তুরাগে জায়গা কিনে বাড়ি বানাতে শুরু করেন। আর্থিক অনটনে ছিলেন তিনি। আমি তাকে মাসে মাসে টাকা দিতাম। প্রায়ই বাইরে নিয়ে উনাকে খাওয়াতাম। কখনও বাসায়ও খাওয়াতাম। আমার ওপর তার বিরাট আস্থা ছিলো। সেই আস্থার জায়গা থেকেই তিনি আপনার মেয়ের আইলটস শেখানোর বিষয়ে আপনাকে ফোন করে জানান। আপনি চলে এলেন পরদিনই।
উত্তর: হুম।
প্রশ্ন: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
উত্তর: এখন তো উন্নত উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটা বেশ শক্তিশালী। ভাবছি একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলবো, আপনাকে দিয়েই। আপনার বাসায় বা রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে গিয়ে গান গেয়ে ইউটিউবে দিবো।
প্রশ্ন: ভালো সিদ্ধান্ত। আপনার কন্ঠ ভালো। গায়কী সুন্দর। এগিয়ে যেতে পারবেন।
উত্তর: আশা করছি। হয়তো এগিয়ে যেতে পারবো।
প্রশ্ন: সবশেষ প্রশ্ন, আপনার হবি কী?
উত্তর: মানুষকে সুন্দর বানানো। মানে মেয়েদেরকে চমৎকার হেয়ার স্টাইলিং করানো। ত্বক সুন্দর করার থেরাপি দেয়া ও বিয়ে বা অনুষ্ঠানের মেকআপ করানো।
প্রশ্ন: চমৎকার আইডিয়া ও কথা। মানুষকে সুন্দর বানানো! সেটা আপনি পারবেন, আপনার সাদা মন ও কারুকার্যময় হেয়ারস্টাইল ও মেকআপ দিয়ে। আপনাকে ধন্যবাদ উত্তরাধুনিকের পক্ষ থেকে।
উত্তর: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
(সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন উত্তরাধুনিক সম্পাদক হাসান জাহিদ (কথাশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও পরিবেশবিদ)